নভেম্বরের শুরুতেই পানি নেই তিস্তায়
নভেম্বর মাসের শুরুতেই ধু-ধু বালুচরে রূপ নিয়েছে সর্বগ্রাসী তিস্তা নদী। গত দেড় মাসে আগেও সেখানে ছিল পানিতে ভরপুর। এখন সেখানে বিপরীত চিত্র। শুকিয়ে খাঁ খাঁ করছে। দেখে মনে হয় যেন এক মরাখাল। বিশাল বালুর স্তূপে মূল গতিপথ হারাতে বসেছে তিস্তা। নদীতে পানি না থাকায় মানবেতর দিন কাটাচ্ছেন হাজারো জেলে । বেকার হয়ে পড়েছে শত শত মাঝি-মাল্লারা। কৃষিতে দেখা দিয়েছে বিপর্যয়।
আজ বুধবার দুপুরে সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, প্রমত্তা তিস্তা নদী যেন এক মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে।
উথাল-পাতাল ঢেউয়ে বিস্তীর্ণ অববাহিকাকে করতো সঞ্জীবিত, সিক্ত আর যা ছিল জীবনদায়িনী তা আজ কোথায় যেন হারিয়ে গেছে । তিস্তা নদীর এ করুণ দশার জন্য পানি চুক্তি না হওয়াকে দায়ী করেছে তিস্তাপাড়ের লাখো কৃষক-জনতা। প্রতি বছর হাজার হাজার একর আবাদি জমি বন্যা ও নদী ভাঙনের ফলে বালুর আস্তরণে ঢেকে যায়। ফলে চাষাবাদের অযোগ্য হয়ে পড়ে। মিঠাপানির মাছের অধিকাংশ প্রজাতি, কীটপতঙ্গ, পাখি, বিভিন্ন প্রাণী যেমন- কেঁচো, ব্যাঙ ক্রমান্বয়ে বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে সাহারা যে প্রক্রিয়ায় মানুষ ও প্রাণী বসবাসের অযোগ্য বনভূমিতে পরিণত হয়েছিল, সমগ্র তিস্তা অববাহিকায় দেশের উত্তরাঞ্চল এখন সেইদিকে ধাবিত হচ্ছে। ইতোমধ্যে তিস্তা অববাহিকায় উত্তরাঞ্চলের অধিকাংশ নদ-নদী ও শাখা প্রশাখাগুলোসহ খাল, বিল, হাওর এবং জলাশয়গুলো শুকিয়ে গেছে।
তিস্তা পাড়ের কৃষকরা আক্ষেপের সুরে জানালেন, যখন পানি চাই তখন পানি পাই না, আর যখন পানি চাই না তখন পানিতে ভেসে বেড়াই। পানিপ্রবাহ নিয়ে অভিযোগের শেষ নেই তিস্তা পাড়ের লাখো মানুষের। তিস্তা ব্যারেজ সেচ প্রকল্পের প্রকৌশলীরা বলছেন, উজান থেকে পানি কম আসায় শুষ্ক মৌসুমে দেশের বৃহৎ সেচপ্রকল্প তিস্তা ব্যারেজে পানিপ্রবাহ মারাত্মকভাবে হ্রাস পায়। পাউবো ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, শুষ্ক মৌসুমে তিস্তার পানিপ্রবাহ ২০০৮ সাল থেকে ক্রমাগত কমছে। বিগত ১২ বছরে কমেছে আশঙ্কাজনক হারে। শুষ্ক মৌসুমে কোনও কোনও সময় পানিপ্রবাহ এক হাজার কিউসেকের নিচে নেমে আসে। তখন পানির তীব্র সংকট দেখা দেয় এবং পানির অভাবে ব্যারেজের সেচ নালাগুলো শুকিয়ে যায়। ফলে ফসলের মাঠ ফেটে চৌচির হয়ে যায়।
এ অঞ্চলে কৃষি, মৎস্য যোগাযোগ, জীববৈচিত্র্য আর বিপুল আর্থিক সংস্থানের আধার তা যেন বালুচরে উত্তপ্ত কড়াউয়ে ভাজা ভাজা হয়ে যাচ্ছে। কবি আর শিল্পীর স্বপ্নময় তিস্তা দুঃসপ্নের হাহাকারে বিস্তীর্ণ। নদীর তীরে যুগ যুগ ধরে গড়ে উঠা সভ্যতা সনাতন পদ্ধতিতে সেচ, নৌ চলাচল পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য মারাত্মকভাবে বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়ে পড়েছে।একইসঙ্গে পানির স্থর নিচে নেমে যাওয়ায় ভূ-গর্ভস্থ পানির ভারসাম্য দ্রুত বিনষ্ট হচ্ছে। নাব্য কমে যাওয়ায় বোরো মৌসুমে সেচ কাজে ভূ-গর্ভস্থ পানির উত্তোলন সম্ভব হচ্ছে না ।
পানি উন্নয়ন বোর্ড ডালিয়া (পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ ) বিভাগ সূত্র জানায়, ১৯৯০ সালে ১৫শ’ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এ তিস্তা সেচ প্রকল্পের মাধ্যমে উত্তরাঞ্চলের কয়েকটি জেলার এক লাখ ১৬ হাজার হেক্টর জমি সেচ সুবিধার আওতায় আনার লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে সেচ কার্য শুরু হয়। কিন্তু ধীরে ধীরে তিস্তার নাব্য কমতে শুরু করলে বগুড়া ক্যানেল বাদ দিয়ে ৯০ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ সুবিধা ধরা হয় ।
স্থানীয় পরিবেশবিদ আবু জাফর চৌধুরীর মতে, তিস্তা নদীর উজানে ভারতের গজল ডোবায় বাঁধ নির্মাণ করায় তিস্তা নদী ক্রমেই তার নাব্য হারিয়ে ফেলছে। এমনকি গোটা তিস্তা শুকিয়ে ধু- ধু বালুচরে রূপ নিয়েছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে গোটা উত্তরাঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তনে আগামী ২-১ বছরের মধ্যে দুর্যোগ ও বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। তিস্তা পাড়ের কৃষক কাচু শেখ, গোলাপ মিয়া ও বোরহান উদ্দিন জানান, তিস্তা নদীর পানি ন্যায্য হিস্যা না পাওয়ার কারণে শুষ্ক মৌসুমে পানির জন্য হাহাকার অবস্থা বিরাজ করে ।
তিস্তা ব্যারেজ রক্ষণাবেক্ষণ প্রকল্পের নির্বাহী প্রকৌশলী রবিউল ইসলাম জানান, বর্তমান সরকার মহাপরিকল্পনার আওতায় তিস্তা নদীর দুই পাড়ে ২২০ কিলোমিটার উঁচু গাইড বাঁধ নির্মাণ করার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। নদী খনন করে গভীরতা বৃদ্ধিসহ তিস্তার দুই পাড়ে গড়ে তোলা হবে হোটেল-রেস্টুরেন্ট। সরকারের এ সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনাটি বাস্তবায়ন হলে পাল্টে যাবে তিস্তার পাড়ের দৃশ্যপট।
সৃষ্টি হবে নতুন নতুন কর্মসংস্থান, ঘুচবে বেকারত্বের অভিশাপ থেকে তিস্তা পাড়ের লাখ লাখ মানুষ। অবশ্য আলোর আলো দেখছেন তিস্তা পাড়ের মানুষ, তারা প্রধানমন্ত্রীর এ উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন।
জেবি
মন্তব্য করুন